Mohammad Ifteakharul Hossain

Rony Iftekhar Forever

আনমনা কলিমন

রনি ইফতেখার

ইদ্রিস মিয়ার ট্রাকটি এসে থামল। পটা পাট ইটগুলো নামছে। ইট নামার শব্দে তেমন কোন মুর্ছনা নেই। তবুও ইদ্রিস মিয়ার শব্দটা ভাল লাগছে। এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় শব্দ হঠাৎই আজকাল ইদ্রিস মিয়ার ভাল লাগতে শুরু করেছে। যেমন, হর্ণের শব্দ । যেখানে হয়ত হর্ণের প্রয়োজন নেই সেখানে অযথাই ইদ্রিস হর্ণ বাজাচ্ছে। ফুর ফুরে মেজাজ যাকে বলে । এ রকম হবার একটা কারণ হয়ত কয়দিন আগে সে বিয়ে করেছে। বউ আবার সুন্দরী! নতুন বউ সব সময় সুন্দরী হয়। ইদানিং ইদ্রিস তাই আর ডবল ট্রিপ-ট্রিপাল ট্রিপ মারেনা। হাতে স্টিয়ারিং ধরা থাকলেও মন পড়ে থাকে ঘরে । এই দুপুর বেলা তাই সে বাসায় ফিরবে ঠিক করল । না জানি বউটি তার একা একা কি করছে? গফুরকে ছুটি দিয়ে ইদ্রিস ট্রাক নিয়ে রওনা হলো। গফুর ইদ্রিসের হেলপার। একটু আগেই ইট নামানো হয়েছে গফুরের ধুয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু ধুতে আরও সময় নষ্ট হবে। বালতি ভরে-ভরে পানি আনতে অনেক সময় লাগাবে গফুর। এ সময়টা আর সহ্য হচ্ছে না ইদ্রিস মিয়ার ।

তার ট্রাকটা ফরিদ মন্ডলের বাড়ীর সামনে দিয়ে নিয়ে যাবার সময় হঠাৎ ফরিদ মন্ডল বেরিয়ে এসে ট্রাকের সামনে দাড়াল। আর একটু হলে গেছিল প্রায়! ইদ্রিস হতবাক । তার ধারনা ছিল কিছু একটা হয়ে গেছে। কিছু একটা হয়ে গেলে সবার আগে কি করতে হয় । তা ইদ্রিসের জানা। কিন্তু সে তা করল না। কারণ, কোন এক কারণে সে ভুলে গেছে । তার চেয়ে বড় কথা কিছুই ঘটেনি। বত্রিশ দাঁত বের করে ফরিদ মন্ডল বল্লেন ইদ্রিস মিয়া যে! কেমুন আছেন? বিবির শ‍ইল বালা?

ফরিদ মন্ডলের বয়স ৫৩। দেখে মনে হয় ৬৩। মাথায় চুল সামান্যই আছে। সাদা দাড়ি। দিনের অধিকাংশ সময় পরনে লুঙ্গী পাঞ্জাবী, রুমাল ও টুপি তাকে। অত্যন্ত অমায়িক ও মিশুক প্রকৃতিক লোক কিন্তু তর পরেও লোকে যে কারণে তাকে পছন্দ করেনা তা হলো, উনি বেশি কথা বলেন এবং ঘরে ওনার দ্বিতীয় পক্ষ আছে এবং উনি তৃতীয় পক্ষের খোঁজ করছেন। ফরিদ মন্ডল দ্বিতীয় বার বল্লেন?

‘ইদ্রিস মিয়া আছেন কেমুন? নাইমা আসেন দুপুরের খানাটা খাইয়া যান’ ।

ট্রাক থেকে ইদ্রিস নেমে পড়ে।

*এক্কেরে তাজ্জব লাগাইয়া দিছিলেন’

‘গরমটা কেমন পড়ছে দেখছেন? আসেন ভেতরে আসেন। ছায়ায় আইসা বসেন । হাত পাংখার দুইটা হাওয়া খান । আপনার সাথে কথা আছে।’

“কি কথা’?

‘জরুলি কথা।’

“আইজ থাউক অন্য দিন—-‘

“কিসের এত তাড়া? খালি টেরাক নিয়া যান কই?”

“না–মাইনে বাড়িত যায় ।’

‘বাড়িত! বাড়িত যাইবেন ক্যা? দুপুরে চাইড্ডা খাইয়া-হুইয়া ঘুমাইতে? হেইডা তো আমার এইখানেও করতে পারেন । আমি সব ব্যবস্থা করতাছি।

‘না আইজ থাউক।’

এমন সময় ঘরে জানালা দিয়ে এক মহিল পদা সরিয়ে বলে ।

“ভাইজান একটু সরবত খাইয়া যান।’

ইদ্রিস বল্ল,

“ভাবী জানের শরিল কেমুন?’

ফরিদ মন্ডল আশ্চার্য হয়ে বলে,

*নাউ যুবিল্লাহ । ওইডা আমার বিবি হইব কোন দুঃখে। হে তো কাজের বিডি ইদ্রিসের লজ্জার নেতিয়ে পড়ার মত অবস্থা হলো ।

সে বল্ল,

“আমি যাই । ঐ দিকে কলিমন ভাত বাইড়া বইসা আছে।’

হতাশ হয়ে বিকৃত মুখে ফরিদ মন্ডল শুধু বলে,

‘অ’

ইদ্রিস ট্রাক স্টার্ট দিল । হঠাৎ তার মনে হলো ।

পেছনে একটা ‘ধুপ’ করে শব্দ হলো। একবার তার মনে হলো পেছনে তাকাবে, কিন্তু তাকাল না। হুস করে ফরিদ মন্ডলের বাড়ী থেকে ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে গেল ।

কলিমন। ইদ্রিসের স্ত্রী। শ্যামলা বর্ণের মেয়েটি এ কয়দিনে পাকা গৃহীনি হয়ে উঠেছে । রান্না বাড়া ছাড়া সে আর যা করে তা হলো সাজ গোজ এবং ইদ্রিসের জন্যে অপেক্ষা। রান্না এবং সাজ-গোজ শেষ হয়েছে। এই গরমে দুপুর বেলায় সে ঠোট রঞ্জিত করে ইদ্রিসের জন্য অপেক্ষা করছে। ঘামে ভিজে যাচ্ছে গা। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে । শাড়ীর আঁচল দিয়ে খুব সাবধানে মুছে নিচ্ছে সে। দুপুর বেলাটা নীরবই থাকে । কেমন যেন মাথা ধরানো নীরবতা। এ সময় অপেক্ষা করা মনে হয় সবচেয়ে কষ্ট কর। দাড়িয়ে থাকতে থাকতে এক সময় তার মনে হয়েছিল ইদ্রিস আজকে আর আসবে না । হতাশ হয়ে সে যখন ঘুড়ে যাচ্ছিল ভেতরে, তখনই ট্রাকের শব্দ কানে এলো । ট্রাক থেকে নেমে ইদ্রিস ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই কলিমন বলে,

*ও আল্লা ট্রাক নিয়া এইখানে আসছেন যে?’

গ্যারেজে যাইবেন না?

*হ জামু । আগে খাইয়া লই ।’

ট্রাক নিয়ে ইদ্রিসের গ্যারেজে যাওয়ার কথা ছিল। কি জানি? কেন যে সে বাড়ীতে চলে এসেছে! গায়ের শার্ট খুলে ইদ্রিস ঘরে গিয়ে বসে। ফ্যান ফুল স্পিডে ছেড়ে দেয়। কলিমন হাত পাখা নিয়ে এসে বাতাস করতে শুরু করে ইদ্রিস ধমকের সুরে বলে,

*ফ্যান তো ঘুড়তাছেই, আবার হাত পাংখা আনছ ক্যা?’

‘ও আল্লা তাইতো । মনেই নাই যে—-শরবত আনমু?’

‘না ভাত খামু । এই সময় মাইনসে ভাত খায় শরবত খায় না।’ “তাইলে হাত মুখ ধুইয়া আসেন।

রান্না ঘরে গিয়ে কলিমনের মাথায় হাত!

বিড়াল ঢুকেছে। বিড়াল দেখেই সে উচ্চ স্বরে বলে,

‘ও আল্লা-

——-

কল পার থেকে ইদ্রিসি শুনে বলে,

‘কি অইল আবার?’

কলিমন মাতমের সুরে বলে

“বিলাই-বিলাই-বিলাই’

“তরকারিতে মুখ দিছে?”

‘না’

কলিমনের রান্না ভালই । তৃপ্তি সহকারে ইদ্রিস খেয়ে ওঠে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলে,

“তুমি খাইয়া লও?’

দশ মিনিটের মথায় ইদ্রিস গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। খাওয়া শেষ করে কলিমন প্লেট ধুয়ে রাখে ।

এরপর কলিমন যায় ট্রাক দেখতে। হঠাৎ ট্রাকের পেছনে তার চোখ যায় । সেখানে তার চোখ যাবার কথা না। কিন্তু সে অতি উৎসাহী হয়ে উঁকি দেয়। তারপর একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে।

‘ও আল্লা!’

ইদ্রিস বিছানায় ধড়ফড় করে উঠে বসে। দৌড়ে বাইরে আসে। দেখতে পায় উঠানের উপর পেছন ফিরে কলিমন দাঁড়িয়ে আছে। মুখ আচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে। “কি অইছে কলিমন ?’

‘আপনার টেরাকে ওইডা কেডা?”

‘সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে ইদ্রিস দেখে একজন মানুষ উপুর হয়ে পড়ে আছে । দেহের নিচ থেকে রক্তের একটা স্রোত বয়ে গেছে। রোদে তা শুকিয়ে ও গেছে। মাথা থেকে কয়েক ইঞ্চি দুরে পড়ে আছে এক ঘাবলা মগজ ।

বাক রূদ্ধ ইদ্রিসের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল,

*এখন কি করি! এযে সরাইতে হইব।’

*ক্যা? পুলিশে খবর দেন।

না! পুলিশে খবর দিলে থানা পুলিশ হইব। মামলা করতে করতে ফতুর হইয়া যামু । আমি থকুম জেলে-বুযেছ? নানান ঝামেলা’

“তাইলে কি করবেন?

‘কল পারে পুইতা রাখুম’

দুপুর বেলাটা নীরবই থাকে । কেমন যেন মাথা ধরানো নীরবতা। খা-খা-রোদ, বেশ সহজেই ওরা কাজটি করে ফেল্ল। কয়েক বালতি পানি দিয়ে ট্রাক ধুয়ে ফেল্ল ।

বারান্দায় দুজন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। অনেক্ষণ পর ইদ্রিসের মুখ থেকে বের হলো, ‘কলিমন, এক গ্লাস পানি দাও।’

কলিমন পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলে,

‘আইচ্ছা আপনে কি হেরে চাপা দিছেন?’

‘কি কও তুমি? আমি অরে চাপা দিমু ক্যা? আর চাপা দিয়া আবার টেরাকে তুইলা নিয়া আসছি?’

কলিমন আবার চুপ হয়ে যায়। দুপুরগড়িয়ে বিকেল আসে। শার্টটি গায়ে জড়িয়ে ইদ্রিস ট্রাক নিয়ে বের হয় । ট্রাক গ্যারেজে রেখে সোজা বাড়ীতে ফিরে আসে। এ সময় টুকু কলিমনের কাটে ভীষন অস্থিরতায়।

অস্থিরতা শুরু হয় এখান থেকেই । ইদ্রিস এবং কলিমন দুজনে ভাগা ভাগী করে নিয়ে তাদের দুর্বিসহ জীবন শুরু করে। প্রথম রাতটি কাটে দুঃস্বপ্নের ভেতর। কলিমন দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সকাল বেলা ভিন্নচিত্র। ইদ্রিস রওনা হয় কর্ম ক্ষেত্রে। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে কলিমন ভীষন ক্লান্ত । ইদ্রিসের যাবার সময় সে বলে,

“আপনি তাইলে যাইতাছেন?’

‘যামুনা তো তোমার মতন শাড়ি চুড়ি পিন্দা ঘরে বইসা থাকুম?’

কলিমন মায়াময় চোখে ইদ্রিসের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার এই তাকিয়ে থাকায় ইদ্রিস বিব্রত হয় । একটু নরম গলায় সে বলে,

“ডরানোর কিছু নাই আমি তাড়াতাড়ি ফিরমুনে খবরদার এই সৰ কতা কাউরে কইওনা কিন্তুক’ ।

বেরিয়ে যয় ইদ্রিস। ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ভয় এবং শূন্যতা এসে সেই ক্লান্তি গ্রাস করতে চায় ।

ছোট বারান্দাটায় এসে বসে পড়ল কলিমন। ভীষন ক্ষুধা লেগেছে কলিমনের। ইদ্রিস সকালে পাউরুটি আর কলা এনেছিল। প্লেটে পাউরুটি আর কলা নিয়ে বারান্দায় বসে খেতে শুরু করল কলিমন। কলিমনের পেছনেই কয়েক ফুট পাকা মেঝের বারান্দা । তার ও পরে মাটির উঠান তারপর কল পাড়।

পাউরুটির টুকরা কলিমনের কাছে মাছের কাঁটার মতো লাগছে। গলায় আটকে যাচ্ছে । বা হাতে পানির গ্লাস নিতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে বলে উঠল 1

‘কলিমন-বু- এক গ্লাস পানি দেন। বড় তিয়াস লাগছে।’

কলিমন পেছন ফিরে দেখে লোকটা বারান্দার খুটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা । কুঁজো হয়ে আছে। হয়ত দাঁড়াবার শক্তি নেই। সারা গায়ে মাটি কাঁদা লেগে আছে। সারা শরীরে এত টুকু আঘাতের চিহ্ন নেই বল্লেই চলে। শুধু মাথার বাম দিকের ওপরের অংশ নেই। সেখানে খুলির অংশটা রক্ত আর কাঁদা দখল করে আছে । কলিমন তাকিয়ে আছে । লোকটা আবার বল্ল,

নাই?

‘পানি দেন।’

‘আপনে ক্যাডা?’

‘আমারে চেনন নাই?’

‘না’

।—-কালকে আমারে মাটি চাপা দিলেন না? মনে

“চিনছেন-চিনছেন চিনাও নাচিনার–

“আপনে তো মইরা গেছেন?’

“তাই নাকি? মাটি চাপা দিলেই মরন যায়?’

‘আপনে তাইলে মরেন নাই?’

“কি মনে হয়?”

‘আপনে মরেন নাই ক্যা?’

‘পানি দেন।’

‘আপনারে পানি দিমু ক্যা-আপনে তো মরা?’ —কেউ পানি চাইলে পানি দিতে হয় নাইলে—‘ ‘আপনের পিছে কল আছে-খাইয়া লন।’

‘সেই শক্তি নাই গো বোন-সেই শক্তি নাই’।

‘আমারে বইন কইবেন না’

“তাইলে কি কমু?’

‘আপনে কি আমার লগে তামাসা করতে আইছেন?’

“না-পানি খাইতে আইছি-পানি দেন।

‘দুর-মরা দেহি মইরাও জ্বালাইবার আইছে ।’

‘ঠিক আছে পানি যখন দিবেন না তাইলে যাই।’

‘কই যান?’

‘কই আর যামু? আমার কি যাওনের জায়গা আছে? আগেও আছিল না, তয় কাইল হইছে। আপনেরা দুইজনে যে গাড়ায় ঢুকাইয়া থুইছেন সেইডা । তয় একখান সমস্যা

হইছে। আসার সময় মাটি সরাইয়া আসছি যাওনের শেষে মাটি টা চাপা দেয়া লাগব । আপনে দিলে একটু ভাল হয় আমার পক্ষে সম্ভব না।’

“আচ্ছা আপনে যাইয়া শুইয়া পরেন। আমি আসতাছি। আমি মাটি চাপা দিয়া দিমুনে।’

একটু পরে কলিমন । মাটি চাপ দিতে ব্যস্ত হয়ে পরে। আর এখনই গফুর এসে উপস্থিত, গফুরের বয়স কম। চিৎকার চেচামেচি করে কয়েক মুহুর্তে সে পাড়ার লোক জড়ো করল। যদিও সে লোক জড়ো করার জন্য আসেনি। সে এসেছিল ইদ্রিসের খোঁজে। একটু পরেই ইদ্রিস-কলিমনের বাড়ীতে বিরাট সংখ্যক লোক জমে গেল । ফরিদ মন্ডলও এল। এরপর ইদ্রিস এলো। একটা মানুষ মরে পরে আছে। এই দৃশ্য দেখার মধ্যে কি আছে? ফরিদ মন্ডলকে দেখে ইদ্রিস চোখ নামিয়ে ফেল্ল। সবাই নিশ্চিত হলো যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ এসে ইদ্রিসকে নিয়ে গেল।

ফরিদ মন্ডল নিসংঙ্গ কলিমনকে তৃতীয় পক্ষ করা যায় কিনা ভাবছেন । সেটা অনেক পরের ব্যপার । আসল ব্যপার ঐ লোকটা এলো কোত্থেকে?

কলিমনকে একা পেয়ে ‘সে’ ঢুকে পরে। কলিমন তখন মসলা বাট্‌ছিল। ধস্তা ধসতির এক পরজায় ‘সে পাটার উপর পরে যায়। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায়। এদিকে শিল নিয়ে প্রায় চার ফুট উপর থেকে কলিমন ‘তার’ মাথায় শিল ফেলে দেয়। বাস। দুপুরে ট্রাক নিয়ে ইদ্রিস এলে ‘তাকে’ ট্রাকে উঠিয়ে ফেলে কলিমন। এসব কিছু করেছে সে ঝোকের মাথায় । ইদ্রিসকে শেষ পর্যন্ত থানা-পুলিশ করতেই হচ্ছে।

ইদ্রিস কি বউকে বাঁচাতে নিজেই দোষ স্বীকার করবে? ট্রাকের চাকায় পিষ্ঠ করে মারলে ট্রাক ড্রাইভারের কি ফাঁসী হয়? এ ধরনের কোন কথা অবশ্য আমি শুনিনি ।

কফিল উদ্দিনের একদিন

রনি ইফতেখার

 কফিল উদ্দিন উত্তর বঙ্গ মেলের দ্বিতীয় শ্রেণীর একটি টিকেট কিনেছেন ট্রেন ছাড়ার সময় লেখা ছিল রাত সাড়ে এগারটা। তিনি যখন টিকেট কাটলেন, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন এগারটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। তার মনে তেমন কোন পরিবর্তন এলোনা । তিনি ধীর পায়ে ট্রেনের দিকে এগুতে লাগলেন। কিন্তু প্লাটফর্ম খুঁজে পেতে ভীষন ঝামেলা পোহাতে হলো। কিছুতেই ট্রেন খুঁজে পাচ্ছেন না। হঠাৎ একজনকে জিজ্ঞেস করলেন। সে দেখিয়ে বলল,

“অ্যামনে গেলে চাকাত চরন লাগব।’

কফিল উদ্দিনের ঘাড়ের কাছ দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল । এত ঝামেলার পর ট্রেন মিস করলে——।

লম্বা পা ফেলে কফিল এগিয়ে গেল। শেষে তাকে একটু খানি দৌড়াতে হয়েছিল । তানা হলে ট্রেনের চাকাও পেত কিনা সন্দেহ। কিন্তু শেষমেস কফিল ট্রেন ধরতে পেরেছিল । রাত প্রায় বারটা। বাতাস কেটে ট্রেন ছুটে চলছে। ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে বরফের মত লাগছে । কফিলের দেহে ঘাম ঝরছে। কারণ, একটু আগে সে দৌড়ে এসে

ট্রেন ধরেছে। ভীড়ের চাপে বাইরে থেকে বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা নেই। বসার জায়গা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। কফিল আশাও করেনি। কফিল লক্ষ করল কিছু লোক ছাদে উঠে ম্যাচ্ছে। একটু পরেই সে শীত বোধ করতে লাগল । পরনের এক প্রস্ত কাপড়। হাত ঘড়ি এবং মানি ব্যগ ছাড়া সে আর কিছুই নেয়নি। কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে লোকজন দেখল সে। একটু পরেই আবিষ্কার করল সে ছাড়া আর কেউ প্যান্ট পরে নেই। নিজেকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই একজন খোঁচা মেরে বল্ল, ‘ভাইজান ম্যাচ আছে, বিড়ি ধরাইতাম ।

কফিল চোখে বিরক্তির বাব ফুটিয়ে বল্ল, ‘না আমি ধূমপান করিনা। নিজের উপর কফিল কম বিরক্ত নয় । হঠাৎ এমন একটা কান্ড বাধাবে ভাবতেও পারেনি। কোন রকম মানসির প্রস্তুতি ছিল না তার। এ ধরনের কাজে মানসিক প্রস্তুতি অবশ্যই প্রয়োজন । কিন্তু “কফিল সাহেব’ এমন ভাবে বল্লেন যে, কোন কিছু ভাবার সময় পাওয়া গেল না। একই মেসে একই রুমে থাকে একই অফিসের দুজন কর্মচারী আশ্চার্য ঘটনা, দুজনের নাম একই কফিল উদ্দিন । কিন্তু আকৃতি ও বর্ণে একটু পার্থক্য আছে। আমাদের আলোচ্য কফিল, লম্বা- হ্যাংলা এবং শ্যামলা।কিন্তু কফিলের রুম-মেট অর্থাৎ দ্বিতীয় কফিল- ফর্সা-খাট এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী । শুধুমাত্র নাম ছাড়া এদের মাঝে আর যে মিল তা হলো দুজনেই অবিবাহিত ।

আজকে সকাল আটটায় কফিল উদ্দিন দাঁত ব্রাশ করছিল। খাট কফিল তখন চাঁদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এমন ঘটনা কখনই ঘটেনা। সবসময়ই দ্বিতীয় কফিল বা খাট কফিল আগে উঠে । কফিল উদ্দিন খাট কফিলকে প্রশ্ন করল,

“কফিল সাহেব, ব্যাপার কি?’

‘আজকে কত তারিখ?”

`নয়ই জানুয়ারী।’

“আরে বাংলা কত তারিখ?’

“দাঁড়ান দেখে নেই । একুশে পৌষ ।

‘অমাবাস্যা না?’

“আমি কিভাবে বলব?

‘আমি জানি অমাবস্যা’

“তাতে কি হলো?’

বলা যাবেনা ভাই। সে এক ভয়াবহ ঘটনা।’

‘অফিসে যাবেন না?’

‘আসি! আমার গায়ে জ্বর এসে গেছে। কখন কি হয়ে যায় আর আপনি বলছেন

অফিসঃ

*জ্বর? কই দেখি

কফিল উদ্দিন কফিলের কপালে হাত রাখে। প্রায় বরফের মত ঠান্ডা।

‘কই জ্বর নেই তো?”

*এখন তাহলে নেই।কিন্তু একটু পরে আবার আসবে।’

‘ব্যাপারটা কি কফিল সাহবে?’

“না ভাই আপনাকে বলে আর বিপদে ফেলতে চাইনা, আপনার বয়স কম।

“কি আমার বয়স কম? বলছেন কি আপনার হয়েছে কি? মস্তিক বিকৃতি জাতীয়—।’ …কিযে বলেন আসলে আপনাকে আর এর মধ্যে জড়াতে চাইনা-তাই এত কথা বলা, কিন্তু আপনি দেখি নাছোড় বান্দা।’

‘আপনি আর আমাকে নিরাশ করবেন না প্লিজ বলুন ।

অমাবস্যা-গায়ে জ্বর আসা-কেমন যেন থ্রিলের গন্ধ পাচ্ছি’।

‘থ্রিল! আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এটা আমার জীবনের একটা সত্য ঘটনা।’ ‘হয়েছে আর প্যাঁচাবেননা আপনার সেই ভয়াবহ ঘটনাটা বলে ফেলুন তো’।

* কিভাবে বলব, অফিসে যাবেন না? তাছাড়া আপনার আজকে বাজার করার ডেট।’ “দুততরি। ঠিক আছে দুঘন্টার মধ্যে আমি আসছি । আপনি কিন্তু কোথাও যাবেন না। ‘পাগল! আমার বাথরুমে যাবার ক্ষমতা নেই আর বলে বাহিরে যাই।’

‘ঠিক আছে আমি আসি।”

কফিল উদ্দিনের মনের ভেতর ঢুকে গেছে দুটো শব্দ অমাবস্যা গায়ে জ্বর আসা-না জানি কি ভয়াবহ ঘটনা। কফিলের ভেতর একবার একটা কিছু ঢুকলে সহজে বের হয়না । কিন্তু এবার বের হয়ে যেতে ধরে ছিল প্রায় । বাজারে ঢুকেই শাহারিয়ার সাহেবের সাথে

দেখা।

শাহারিয়ার আহমেদ কফিল উদ্দিনের ফুপা। কফিল উদ্দিনের চাকরি পাপ্তির ব্যাপারে শাহারিয়ার আহমেদ মুক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন। চাকরি প্রাপ্তির আগে কফিল উদ্দিন ছয়মাস শাহারিয়ার আহমেদের বাড়িতে ছিল । শাহারিয়ার আহমেদের দুই কণ্যা। লিজা শাহারিয়ার এবং লিন্ডা শাহারিয়ার। কফিল এদের কাছে একটি মজার মানুষ। কফিল সব সময় একটু অন্য মনস্ব। মিসেস আহমেদ কফিলের ফুপু। কফিলকে খুবই স্নেহ করেন। কফিল খুব কমই যায় লিজাদের বাড়িতে। বাজারে দেখা হতেই শাহারিয়ার বল্লেন,

‘কিরে? তোকে না কাল বল্লাম বাসায় যেতে?’

“এক দম ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু ব্যপার কি?

`ব্যাপার কি মানে? আজকে লিজার জন্মদিন মনে নেই?’

“মনে থাকবে কিভাবে? আমি তো মুনিই নি।

“ও তোমাকেতো বলাই হয়নি। ঠিক আছে তোর অফিসে যেতে হবে না। আমি বলে

এসেছি।’

“কিন্তু আমি গিয়ে করব কি?’

“তুই করবি কি মানে? বাড়ি শুদ্ধ এতগুলো লোক খাওয়াচ্ছি একটা অনুষ্ঠান কত ঝামেলা!’

লিজা-লিন্ডাদের বাড়িতে বিরাট আয়জন। সাজানো হয়েছে বিয়ে বাড়ীর মত করে। কফিল উদ্দিন ভেতরে ঢুকে তোপের মুখে পড়ল। ফুপি আচ্ছা করে বকুনি দিলেন । তারপর কাঁদতে শুরু করলেন। কারণ তার রক্তের একমাত্র উত্তরাধিকারির হাল দেখে ৷

লিজা শাহারিয়ার। শাহারিয়ার আহমেদের বড় মেয়ে । আজ তার জন্মদিন। আজ সে একটি শাড়ী পড়েছে। শাড়ী পড়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে সারা বাড়ী । কপালে শাড়ীর সাথে ম্যাচ করা টিপ । কফিল উদ্দিন লিন্ডার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ লিজা ঢুকল । লিন্ডা বলে উঠল ।’ ‘কফিল ভাই দেখেন তো এই মহিলাকে চিনতে পারেন কিনা?”

কফিল হতবাক,

‘আসসালামু-আলাইকুম-আপনাকে ঠিক চিনতে পারলামনা-’

লিন্ডা হেসে উঠল,

‘আপাকে চিনতে পারলেন না-?’

“কোন আপা?’

লিজা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

লিন্ডা চোখ কপালে তুলে বল্ল,

“কোন আপা মানে?’

‘ওহ! লিজা? কি আশ্চার্য, একদম চিনতে পারিনি।’

বিকেল তিনটার সময় কফিল উদ্দিনের খাট কফিলের কথা মনে পড়ল এবং বাড়ী (থেকে এক রকম পালিয়ে কফিল মেসে এলো। দ্বিতীয় কফিল তখনও ·ি ছানায় শঙ্খা শায়ী । তার মুখ শুকিয়ে গেছে। সারাদিন কিছু খেয়েছে বলে মনে হয়না। কফিল কপালে হাত দিয়ে দেখল । জ্বর আছে, কপালে হাত দেয়ামাত্র দ্বিতীয় কফিল জেগে উঠল

‘আপনি এসেছেন, আমাকে একটু বাথ রুমে নিয়ে যাবেন? সকাল থেকে একবারও য্যাইনি।’

‘বলেন কি?’

“যাব কি ভাবে? বিছানা থেকে নামার শক্তি নেই ।

‘আচ্ছা-চলুন’

খাট কফিল খাট হলেও তার ওজন সম্পর্কে কফিলের ধারনা ছিলনা। ঘাম ছোটর মত অবস্থা’। বিছানায় শোয়ানোর পর বল্ল,

‘আপনার তো কথা বলারই শক্তি নেই, কিন্তু আপনার ভয়াবহ ঘটনা শুনেত ইচ্ছে করছে।’

কফিলকে অবাক করে দিয়ে খাট কফিল বলল,

“আমি বলব’

‘বলেন কি?’

“হ্যাঁ, বলে এক ধরনের শান্তি আছে।’

“আজ থাক । আজ আপনি অসূস্থ।’

“তবুও বলব।’

“দ্বিতীয় কফিল অর্থাৎ খাট কফিল শুরু করলেন এভাবে।

“বছর দুয়েক আগে একবার ছুটিতে যাচ্ছিলাম। দিন তারিখ মনে নেই । শুধু মানে আছে অমাবস্যা । গাঢ় অমাবস্যা। ওহ! মনে হলেই– —। আপনি তো জানেন আমি কঞ্জুস ধরনের । টাকা পয়সা কম খরচ করি। দেশের বাড়িতে মা আর ছোট ভাইবোনদের জন্য কমলা কিনে নিলাম । ট্রেন চড়ার আগেই উঠে বসলাম। কি এক অজ্ঞাত কারণে ট্রেন ছাড়তে আধা ঘন্টা দেরি হয়ে ছিল ।

শীতের রাত । অন্ধকারের ভেতর ট্রেনটি এগিয়ে যাচ্ছিল । গতিটা যেন শ্লথ। আড়াই ঘন্টার বেশি লাগেনা ঘল্লামারি স্টেশনে পৌছাতে। আমি ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘল্লামারির ঠিক আগের স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। একটু পড়েই তা চলতে থাকল । আমি জানি এর পরই ঘল্লামারি স্টেশন। নামার প্রস্তুতি নিলাম । ট্রেন থামল । বেশ কয়েক জন আমার সাথে নামল। ট্রেন ছেড়ে দিল। তখনই আবিস্কার করলাম এটা ঘল্লামারি স্টেশন নয়। স্টেশনের আগেই নেমে গেছি। সবাই যার যার মত চলে গেল। আমি কাউকে জিজ্ঞেস করলাম না অপরিচিত বলে যদি সর্বস্য কেড়ে ছেড়ে দেয় এই ভয়ে। রাত একটা পেরিয়ে গেছে। চারদিকে কুয়াশা আর অমাবস্যার অন্ধকারকে এত গাঢ় করেছে সামনে শুধুই অন্ধকার দেখা যায়। রেল লাইন ধরে হাঁটতে থাকলাম । রেল লাইনের গা বেয়ে অনেক রাস্তা একে বেঁকে বেরিয়ে গেছে। হয়ত এ রাস্তা দিয়েই আমার গ্রামে যাওয়া যায় । কিন্তু যাব কি ভাবে? তার চেয়ে হেঁটে স্টেশন পর্যন্ত গেলে রিক্সা-ভ্যান যা হয় একটা পাওয়া যেত । এত রাতে এই ঠান্ডায় কেউ যাবে না জানি । তবুও মনকে সান্তনা দেয়ার একটা উপায়। কিছু দুর হাঁটার পরই ক্লান্তি বোধ করলাম। রেল লাইন থেকে একটু দুরেই বাড়ী-ঘর দেখা যায় । একবার ইচ্ছে হলো এক বাড়ীতে ঢুকে পরি। ক্ষুধাও অনুভব করলাম। একবার ঢুকেই পড়েছিলাম প্রায়। হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকারে ফিরে গেলাম । দ্বিতীয় যে রাস্তায় ঢুকলাম সে রাস্তায় নেমে পড়লাম বিভ্রান্তিতে। রাস্তায় এক সাইডে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পাড়লাম না-এখানে ভ্যান আসবে কোত্থেকে? প্রথমে অন্ধকারে খেয়াল করিনি। পরে দেখলাম ভ্যানের উপর চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ভ্যান চালক। ওকে ডাকলাম। কোন সাড়া নেই। এভাবে শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে কেউ শুয়ে থাকতে পার, আমার ধারনাই ছিলনা। ভ্যান ধরে দিলাম এক ঝাকুনি। ভ্যান চালক ধড় ফড় করে উঠে বসল। আমার গ্রামের নাম বলতেই সে চিনল। আমার বিপদের কথা তাকে বল্লাম। সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। এখানে সে এসেছে নাইওর নিয়ে। সারা রাত থেকে সকালে আবার ফিরে যাবে । সারা রাত সে ঠান্ডার মধ্যে থাকতে চাচ্ছেনা।

ভ্যানের উপর উঠে বসলাম । ভ্যান চালক রাস্তার পাশে বসে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পন্ন করল । কোমড়ে গোজানো লুঙ্গী থেকে বিড়ি নিয়ে বিড়ি ধরালো, তারপর সবার অজান্তে সবুজ

Scroll to Top